সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৬ অপরাহ্ন

নারী জমিদারের শাসন ছিল শ্রীফলতলী জমিদারেএস্টেটে

গবেষনা- তোফায়েল হোসেন তোফাসানি
  • আপডেট সময় : 4:26 pm, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

তালিবাবাদ পরগণার জমিদারদের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে  জানতে পারলাম যে, এই জমিদারেরা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব বাহিনী।  তৈরী করতেন গোলা বারুদ। 

এদিকে, বৃটিশ সরকারের দেয়া শর্ত মোতাবেক ঢাকার সাভার থেকে এলাকা ভাগ করে গড়ে তোলা হয় আলাদা একটি প্রশাসনিক থানা। সে সময়ের এই থানাটিই এখনকার কালিয়াকৈর থানা। 

আজ জানবেন তালিবাবাদ পরগণার শ্রীফলতলী জমিদারী এস্টেটের অনেক অজানা কথা। জানাবো মসজিদের ভেতরে কেন দাফন করা হয়েছিল এই শ্রীফলতলীর নারী জমিদারকে। আর এসব সমাধীতে যারা ঘুমিয়ে আছেন তারা কত প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন সেই ইতিহাস খুঁজেছি এই মহলের সর্বশেষ বংশধরদের কাছে।  

এই ভবনটি ‘শ্রীফলতলী জমিদারবাড়ির পশ্চিম তরফ। এই গ্রামের নাম শ্রীফলতলী হওয়ার পেছনে রয়েছে চমৎকার ইতিহাস। 

জানা গেছে, “শ্রীফল” অর্থ বেল। এই গ্রামে প্রচুর বেল গাছ ছিল। যে গাছে বেল ধরে তা পেকে সুবাস ছড়াতো গ্রামবাসী ও পথচারীদের মাঝে। বেলের মিষ্টি গন্ধে যেন মাতাল হয়ে যেত মন। তাই এই “শ্রীফল থেকে শ্রীফলতলী গ্রামের নামকরণ করা হয়। যার অর্থ দাঁড়ায় বেল গাছ তলা। 

শ্রীফলতলী এস্টেটের যাত্রা শুরু হয় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে। তারা তালেব গাজীর বংশধর ছিলেন। তালেব গাজীর নামেই তালেবাবাদ পরগণার নামকরণ করা হয়। এই তালেবাবাদ পরগণার নয় আনা অংশ নিয়ে “শ্রীফলতলী এষ্টেট’ গঠিত হয়। তারা ভূরখের অধিবাসী ছিলেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য ভারত বর্ষে আসেন ভূরখ অধিবাসীদের কিছু অংশ। তারা প্রথম বর্তমান কালিয়াকৈর চান্দরা এলাকার মনাই বিবির দিঘীর পাড়ে বসতি স্থাপন করে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যা ভাঙ্গা মসজিদ নামে সকলের কাছে পরিচিতি। ঐ মসজিদটি স্থানীয় জনগণ পুনরায় সংস্কার করেন। ঐ খানের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর না থাকায় তারা শ্রীফলতলী নামক স্থানে পুনরায় বসতি স্থাপন করে।

আলী নেওয়াজ সাহেবের স্ত্রী রমজানুন নেছা ১২২৪ হিজরীর ১লা মুহাররম এখানে একটি মসজিদ স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তার বংশধর রহিম নেওয়াজ খান জনহিতকর কাজের মাধ্যমে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। রহিম নেওয়াজ খানের শাসনামলে পরগণার জনসাধারণ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতেন। সমাজ ও দেশ সেবায় তাঁর অবদান ছিল অনবদ্য। তিনি পরগণার জনগণের কল্যাণ সাধন ও তাদের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে এবং উচ্ছৃংখল দুষ্ট চরিত্রের লোকদের দমনের জন্য সাভার থানাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নিজস্ব জমিতে কালিয়াকৈর থানা গঠন করেন। পরে তাঁর নাতি সৈয়দ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বা শাহ্জাহান চৌধুরী ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে এম.পি.এ নির্বাচিত হওয়ার পর কালিয়াকৈর থানায় ব্যপক উন্নয়ন মূলক কাজ করেন। অতঃপর রহিম নেওয়াজ খান মারা যাওয়ার ১০০ বছর পর তাঁরই বংশধর সৈয়দ আফজাল হোসেন চৌধুরী (আপেল) শ্রীফলতলী জমিদারবাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও বাড়িটি পুন: সংস্কার করেন।

শ্রীফলতলী জমিদারী এস্টেটের প্রধান কর্ণধার খোদা নেওয়াজ খান বিয়ে করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে আকরামুননেছাকে। এই দম্পত্তির ঘরে জন্ম নেয় ছয় কন্যা ও দুই পুত্র সন্তান। স্বভাবগতভাবে নরম মনের অধিকারী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জমিদার রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরী ছিলেন তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি টাংগাইলের পাকুল্লার জমিদারবাড়ির কন্যা ফাতেমা খাতুন চৌধুরানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরীর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তিনি তিন কন্যা সন্তানের– জনক। তারা হলেন সালেহা বানু চৌধুরানী, কৈশার বানু চৌধুরানী ও বিলকিস বানু চৌধুরানী। সালেহা বানু চৌধুরানীর বিয়ে হয় চাচাতো ভাই খালেক নেওয়াজ খান চৌধুরীর সাথে। কৈশার বানু চৌধুরানী ও বিলকিস বানু চৌধুরানীর বিয়ে হয় বগুড়া শিবগঞ্জ জমিদারবাড়ির দুই পুত্র যথাক্রমে সৈয়দ মোফাখখার হোসাইন চৌধুরী ও সৈয়দ বেলায়েত হোসাইন চৌধুরীর সাথে। বিলকিস বানু চৌধুরানী ও সৈয়দ বেলায়েত হোসাইন চৌধুরী দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। কৈশার বানু চৌধুরানী ও সৈয়দ মোফাখখার হোসাইন চৌধুরী দম্পত্তির ঘরে জন্ম নেন ছয় পুত্র ও পাঁচ কন্যা সন্তান। তারা হলেন সৈয়দ মোফাজ্জল হোসাইন চৌধুরী যিনি শাহজাহান চৌধুরী নামে পরিচিত। সৈয়দ মোতাহার হোসাইন চৌধুরী যিনি শাহ্ আলম নামে পরিচিত, সৈয়দ মোজাম্মেল হোসাইন চৌধুরী, সৈয়দ জাহেদ হোসাইন চৌধুরী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইন চৌধুরী, সৈয়দ মোবাশ্বির হোসাইন চৌধুরী, সৈয়দা রওশন জাহান, সৈয়দা রওনক জাহান, সৈয়দা কিশোয়ার জাহান, সৈয়দা ফক্সে জাহান ও সৈয়দা সুলতানা জাহান চৌধুরানী। রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরীর বংশ ধারা টিকে আছে তার কন্যা সন্তান কৈশার বানু চৌধুরানীর মাধ্যমে।

জমিদারি পরিচালনায় তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও উদারতার পরিচয় দেন। তার সময়েই শ্রীফলতলী জমিদারি ব্যাপক প্রসার লাভ করে। তার পরগণায় হিন্দু-মুসলিম পরস্পর সহযোগিতা, সাম্প্রদায়িকতা, সম্প্রীতি, পারস্পারিক সম্মান, শ্রদ্ধা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। তার পরগণা পরিচালনায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যমতের ব্যাপক প্রসার ঘটে। পরগণার পরিচালনার সুবিধার্থে তিনি নিজের কাচারী বাড়ির পাশাপাশি আষাঢ়িয়া বাড়ির বাগানবাড়িকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন।

তাঁর জমিদারির পরিসীমা ময়মনসিংহ, নরসিংদী ও সাটুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নিজের জমিদারী পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তুলেন। এই নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য তিনি নিজের বাসায় নিজস্ব উদ্যোগে গোলাবারুদ তৈরি করতেন। কালিয়াকৈর থেকে ফুলবাড়ীয়া পর্যন্ত এলাকা বিপদজনক হিসেবে চিহ্নিত করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনিবার্য কারণ হিসেবেই এ বাহিনী গড়ে তোলেন জমিদারেরা।

আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে তালিবাবাদ পরগণা সাভার থানার অন্তর্ভূক্ত ছিল। বিংশ শতাব্দির প্রারম্ভে গাজী বংশের উত্তরসূরি রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরীর একান্ত প্রচেষ্টায় এ এলাকাকে পৃথক থানার মর্যাদা দিয়ে কালিয়াকৈর নামকরণ করা হয়। বৃটিশ সরকারের দেয়া শর্ত মোতাবেক তিনি তুরাগ নদীর তীরবর্তী নিজস্ব জায়গায় থানা বা পুলিশ ষ্টেশন নির্মাণ করেন। সাথে সাথে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানও নিজস্ব জায়গায় নিজ ব্যয়ে নির্মাণ করেন। কালিয়াকৈরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রধান রূপকার রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরী। তাঁর শাসনামলে পরগণার জনসাধারণ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতেন। সমাজ ও দেশ সেবায় তাঁর অবদান ছিল অনবদ্য। তিনি জনসাধারণের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেন। 

দর্শক, শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ির ইতিহাস যেন এক রূপ কথার কাহিনী। এই মসজিদটি ১৩ শ শতাব্দির ইতিহাস বহন করে চলেছে। এই মসজিদের ভেতরে রয়েছে এই নারী জমিদারের কবর। 

শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ির বাকি ইতিহাস নিয়ে ফিরছি পরের পর্বে। আমার এই ফেসবুক পেইজ লাইক দিয়ে ফলো করে পাশে থাকা এবং ভিডিও শেয়ার করে অন্যকে দেখার সুযোগ করে দিতে অনুরোধ জানাচ্ছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই রকম আরো জনপ্রিয় সংবাদ
© All rights reserved © 2017 Cninews24.Com
Design & Development BY Hostitbd.Com