আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। যার শাসনকাল ছিল ১৪৯৩-১৫১৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মধ্যযুগে বাংলার স্বাধীন সুলতান। তিনি হোসেন শাহি রাজবংশের পত্তন করেন। হাবশি সুলতান শামসউদ্দিন মোজাফফর শাহ নিহত হওয়ার পর তিনি বাংলার সুলতান হন। ইতঃপূর্বে তিনি মোজাফফর শাহের উজির ছিলেন। তার শাসনামল কে বাংলার স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়।
১৫১৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তার পুত্র নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ ক্ষমতালাভ করেন।
প্রথম জীবন
হোসেন শাহের মূল নাম ছিল সাইদ হোসেন। ১৭৮৮ সালে লেখা রিয়াজুস সালাতিন অনুসারে তিনি তিরমিজের বাসিন্দা মক্কার শরিফ সাইদ আশরাফুল হোসাইনি আল ফাতিমি আল মাক্কির পুত্র ছিলেন। রিয়াজুস সালাতিন এর লেখক ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেন সেলিম ও মুহাম্মদ কাসিম হিন্দু শাহ তাকে সাইদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা তার আরব বংশোদ্ভূত হওয়ার চিহ্ন বহন করে। পাশাপাশি সুলতান হোসেন শাহ বিন সাইদ আশরাফুল হুসাইনি কথাটি তার মুদ্রায় উল্লেখিত হয়েছে। তবে তার বাংলায় আগমন ও সুলতান শামসউদ্দিন মোজাফফর শাহের উজিরের পদ লাভ করার ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায় না। ধরা হয় যে তিনি প্রথমে মুর্শিদাবাদ জেলার চাঁদপারা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এর কারণ হোসেন শাহের প্রথম দিকের বেশ কিছু বিবরণ এই গ্রামের আশেপাশে পাওয়া যায় এবং ১৪৯৪ সালে হোসেন শাহ কর্তৃক নির্মিত খেরুর মসজিদ এখানে অবস্থিত। শেখের দীঘি নামক একটি জলাশয়ও তার সাথে সম্পর্কিত।
প্রথমদিকে তিনি গোপনে বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানালেও পরবর্তীকালে প্রকাশ্যে তাদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং দুর্গ অবরোধ করেন। এখানে সুলতান শামসউদ্দিন মোজাফফর শাহ কয়েক হাজার সৈনিক সমেত অবস্থান করছিলেন। ১৬ শতকের ইতিহাসবিদ নিজামউদ্দিন আহমেদের মতানুযায়ী, সুলতান গোপনে প্রাসাদ রক্ষীদের সাহায্যে হোসেন শাহ কর্তৃক নিহত হন। এর মাধ্যমে বাংলায় হাবশি শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
শাসনকাল
হোসেন শাহ ২৫ বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসনামলে তৎকালীন রাজ্যে শান্তি বজায় ছিল। হিন্দু প্রজাদের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি তার আমলের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
প্রাথমিক শাসনতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড
ক্ষমতালাভ করার পর গৌড়ে লুটপাট থেকে ফিরে আসার আদেশ দেন আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ। কিন্তু তারা তা অব্যাহত রাখলে তিনি বার হাজার সৈনিককে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং লুট হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করেন। এর মধ্যে ১৩,০০০ স্বর্ণের প্লেট ছিল। এরপর তিনি প্রাসাদরক্ষীদের দলকে বিলুপ্ত করেন। প্রাসাদের ভেতর এরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল। প্রশাসন থেকে তিনি হাবশিদের সরিয়ে দেন এবং তাদের স্থলে তুর্কি, আরব, আফগান ও স্থানীয় লোকদের নিয়োগ দেন।
দিল্লী সালতানাতের সাথে সংঘর্ষ
জৌনপুরের সুলতান হোসেন শাহ শারকি বাহলুল খান লোদির কাছে পরাজিত হওয়ার পর বিহারে ফিরে আসেন। সেখানে অল্প এলাকায় তার কর্তৃত্ব বহাল ছিল। ১৪৯৪ সালে তিনি পুনরায় সিকান্দার লোদির কাছে পরাজিত হন এবং বাংলায় পালিয়ে যান। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাকে আশ্রয় প্রদান করেন। এর ফলে সুলতান সিকান্দার লোদি ১৪৯৫ সালে বাংলার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। দিল্লীর সেনাদের বিরুদ্ধে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র দানিয়েলের অধীনে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। দুই বাহিনী পাটনার কাছে বড়হ নামক স্থানে মিলিত হয়। সিকান্দার লোদি তার সেনাদের অগ্রযাত্রা থামানোর নির্দেশ দেন এবং আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি করেন। এই চুক্তি মোতাবেক বড়হের পশ্চিমাঞ্চল সিকান্দার লোদির অধীনে যাবে এবং পূর্বাঞ্চল আলাউদ্দিন হোসেন শাহের অধীনে থাকবে। জৌনপুর সালতানাতের চূড়ান্ত বিলুপ্তির ফলে এর সেনারা বাংলার সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং একে শক্তিশালী করে তোলে।
কামতা-কামরূপ অভিযান
১৪৯৯ থেকে ১৫০২ সাল পর্যন্ত হোসেন শাহের সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজি কামাতা রাজ্য আক্রমণ করেন এবং হাজো পর্যন্ত এলাকা দখল করে নেন। কামতার রাজা নীলাম্বরকে বন্দী করা হয় ও রাজধানীর সম্পদ দখল করা হয়। মালদার একটি বিবরণীতে এটি লিপিবদ্ধ করা হয়।
উড়িষ্যা অভিযান
মাদালা পাঞ্জির মতে শাহ ইসমাইল গাজি ১৫০৮-০৯ সালে মান্দারান দুর্গ বর্তমান হুগলি জেলা থেকে তার অভিযান শুরু করেন এবং পুরী পৌঁছান। পথে জজপুর ও কটক আক্রমণ করা হয়। উড়িষ্যার গজপতি শাসক প্রতাপরুদ্র দক্ষিণের অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। এ সংবাদ পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। তিনি বাংলার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন ও বাংলার সীমান্ত পর্যন্ত তাদের পিছু নেন। তিনি মান্দারান দুর্গ পৌঁছান ও এটি অবরোধ করেন কিন্তু তা দখলে ব্যর্থ হন। হোসেন শাহের শাসনামল জুড়ে বাংলা ও উড়িষ্যার মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল।
ত্রিপুরা ও আরাকান অভিযান
রাজমালা নামক ত্রিপুরার রাজকীয় বিবরণী অনুযায়ী হোসেন শাহ চারবার ত্রিপুরায় সেনা প্রেরণ করেন। কিন্তু ত্রিপুরার সেনারা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং কোনো অঞ্চল তাদের হাতছাড়া হয়নি। কিন্তু খাওয়াস খানের সোনারগাঁ বিবরণী যা আধুনিক বেশ কিছু পণ্ডিত ব্যবহার করেন, তা অনুযায়ী ত্রিপুরার একটি অংশ হোসেন শাহের সেনারা দখল করে নেয়।
ত্রিপুরায় হোসেন শাহের অভিযানের সময় আরাকানের শাসক ত্রিপুরার শাসককে সাহায্য করেন। তিনি চট্টগ্রামও দখল করেন ও হোসেন শাহের কর্মকর্তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। ১৫১৩ সালে হোসেন শাহ পরাগল খানকে আরাকান আক্রমণের দায়িত্ব দেন। পরাগল খান ফেনী নদীতে তার কেন্দ্র থেকে অগ্রসর হন। পরাগল খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র ছুটি খান অভিযানের দায়িত্ব নেন এবং আরাকানিদের কাছ থেকে চট্টগ্রামের দখল কেড়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত তা পরিচালনা করেন। এই লড়াই ১৫১৬ সালের দিকে শেষ হয়।
পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা ১৪৯৮ সালে সমুদ্রপথে ভারত আসেন।[৩] হোসেন শাহের রাজত্বের শেষের দিকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি পর্তুগিজ দল বাংলায় আসে।
আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে বাংলা সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধি লাভ করে। হোসেন শাহের অধীন চট্টগ্রামের শাসক পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর তার পান্ডববিজয় রচনা করেন। এটি মহাভারতের একটি বাংলা সংস্করণ। একইভাবে পরাগল খানের উত্তরাধিকারী হিসেবে চট্টগ্রামের গভর্নর হওয়া তার পুত্র ছুটি খানের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকর নন্দী মহাভারতের আরেকটি সংস্করণ বাংলায় রচনা করেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর তার পান্ডববিজয় গ্রন্থে হোসেন শাহকে কলি যুগের কৃষ্ণের অবতার হিসেবে প্রশংসা করেছেন। বিজয় গুপ্ত তার মনসামঙ্গল এসময় রচনা করেন। তিনি হোসেন শাহকে অর্জুনের সাথে তুলনা করেছেন। এতে হোসেন শাহকে নৃপতি-তিলক (তিলক অর্থ রাজার চিহ্ন) ও জগৎ-ভূষণ (বিশ্বের সৌন্দর্য) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হোসেন শাহের একজন কর্মকর্তা যশরাজ খান কিছু সংখ্যক বৈষ্ণব পদ রচনা করেন। তিনিও তার একটি পদে হোসেন শাহের সুনাম করেছেন। হোসেন শাহের আমলে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ইমারত গড়ে উঠে। ওয়ালি মুহাম্মদ গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ নির্মাণ করেন।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা
হোসেন শাহের রাজত্বকাল হিন্দু প্রজাদের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত। তবে আর. সি. রের দাবিমতে উড়িষ্যা অভিযানের সময় তিনি কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন। হোসেন শাহের রাজত্বকালে মধ্যযুগের সমাদৃত ধর্মগুরু চৈতন্য মহাপ্রভু ও তার অনুসারীরা ভক্তি প্রচার করেন। হোসেন শাহ তার ব্যাপারে জানতে পারলে কাজীকে নির্দেশ দেন যাতে তাকে কোনো প্রকার বাধা প্রদান করা না হয়। পরবর্তীতে তার প্রশাসনের দুজন উচ্চপর্যায়ের হিন্দু কর্মকর্তা ব্যক্তিগত সচিব (দবিরে খাস) রুপা গোস্বামী ও তার ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী (সগির মালিক) সনাতন গোস্বামী চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারী হন।
আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে সকল ধর্মের সহাবস্থান এবং উদার নীতির কারণে সেই আমলকে অনেকেই স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেন। তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া