এমনও প্রেম হয়, যে প্রেম মৃত্যু দিয়ে প্রমান করে “ভালবাসি।’ সিনেমার গল্পের মত এমন একটি প্রেমের বাস্তব কাহিনী জানাবো-
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। প্রতিদিন টেলিফোন অফিসের পেছনে বসে সমবয়সী শিশুদের খেলা দেখতাম। তখন আমি দশম শ্রেণীতে পড়ি। ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার প্রতি আসক্ত না থাকায় নিজে কখনও ওদের সাথে খেলতে যেতাম না। শুধু বসে বসে ওদের খেলা গুলো উপভোগ করতাম। টেলিফোন অফিসের কাছেই ছিল আমার গানের ওস্তাদের হারমোনিয়াম মেরামতের দোকান। সেই সুবাদে বাড়ি থেকে ওস্তাদের দোকান আর সেখান থেকেই টেলিফোন অফিসের পেছনে এই সময় কাটানো ছিল আমার রীতিমতো অভ্যাস।
প্রতিদিন শিশুদের খেলা গুলো অনুভব করতাম। ওদের সাথে খেলতে চাইতাম। মন কেন যেন বাধা দিত। কারন আমার মন পরে থাকত গান শেখার আসরে। তাই ছোটবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো খেলাধুলায় আমি অভ্যস্ত নই। টেলিফোন অফিসের পেছনে রীতিমতো আমার বয়সীদের গোল্লাছুট খেলা, বউছি খেলা, কানামাছি খেলা, চোর-পুলিশ খেলা, এমন কত খেলা যে হত। এসব দেখে দেখে আমি খুব আনন্দ পেতাম। খেলার ছোট মাঠটি যেন একটি আনন্দ আশ্রম। সেখানে আইয়ুব মামা এসে গাছের লতাপাতা ছিঁড়ে আমাদেরকে পুরস্কার দিত। এসব পুরস্কারগুলো আমাদের কাছে খুবই লোভনীয় ছিল। মোরগ ফুল, ধুতরা ফুল, তেলাকুচ, এগুলুই ছিল মূলত পুরষ্কারের সামগ্রী। সেসময়ের এসব ছোট ছোট আনন্দগুলো আমাদেরকে অনেক অনুপ্রাণিত করতো। যে কারণে গানের আসর আর খেলার এই ছোট্ট মাঠটি ছিল আমাদের কাছে প্রিয় একটি জায়গা।
হঠাৎ একদিন সমবয়সীদের খেলা দেখছি। মাঠের পূর্ব পাশে চোখ পড়তেই দেখলাম খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরা ৭/৮ বছরের একটি মেয়ে তার গৃহপালিত ছাগলকে ঘাস খাওয়াচ্ছে। খেলার মাঠে প্রতিদিনই এই মেয়েটি আসে ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে। এজন্যই তাকে সবাই “ছাগী’ বলে ডাকে। মূলত তার নাম ছিল সাহেরা খাতুন। গায়ের রং ছিল কাল। সব সময় শরীরে যেন তার মাটি লেগেই থাকত। খেলার মাঠ থেকেই জানলাম মেয়েটিকে। প্রতিদিন সে ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে আসতো, আর দূর থেকে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। প্রথমে বিষয়টি আমি খেয়াল করিনি। বন্ধুরা বলার পরে আমার নজর তার দিকে বারবার ফিরে যেতো। আমি তার দিকে তাকালেই মেয়েটি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত। আমারও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে খুবই ভালো লাগতো। দিনের পর দিন এই ভালোলাগাটা অনেক বাড়তে থাকে। কয়েকমাস পরে আমি অনুভব করতে শিখি আমার ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে।
একদিন ছাগী নামের সেই মেয়েটি আমার সামনে। লজ্জা-শরম রেখে সেদিন বলেই ফেলল- “আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ শুনে কেমন যেন আঁতকে উঠলাম, তবে আমার ভেতরেও যে ভালোবাসার ঝড় বইছে সেটা অনুভব করতে পারলাম। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলাম না। তিন চারদিন পরে মেয়েটি আমার সামনে। সেদিন আমাকে সে বলছে- “তুমি আমাকে ভালবাসতে চাও না? আমাকে তোমার ঘেন্না হয়? আমি কালো, গায়ে ময়লা থাকে এর জন্য?’ সেদিনও আমি মেয়েটিকে কিছু বলতে পারিনি। বুকের ভেতর ধক ধক করে কেঁপে উঠছে। যেন কেউ হাতুড়িপেটা করছে, আর হাত পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কিন্তু মুখে আমার কোন ভাষা নেই। কি বলব কিভাবে বলব সেই বলার ভাষাটিও আমি তখন জানিনা।
এভাবে আরো চার-পাঁচ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। বন্ধুদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করলাম। ওদের কাছ থেকে শিখে নিলাম কি বলতে হবে আর কিভাবে বলতে হবে। তারপর একদিন মেয়েটি যখন আমার কাছে উত্তর জানতে আসলো ঠিক তখনই বললাম “আমিও তোমাকে ভালোবাসি।’ এই ভালোবাসা টি ছিল দূর থেকে দেখা আর অনুভব করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেন কাছে আসা বারণ। সমাজ-সংসার, অভিভাবক সবকিছুই যেন আমাদের কাছে বাধা হয়েছিল।
আশির দশকের এই প্রেম আর এখনকার প্রেমের মধ্যে অনেক তফাৎ। সে সময় দূর থেকে দেখা, চিঠি লেখা, এগুলোই ছিল মূলত প্রেম আর প্রেমের অনুভূতি। এই অনুভূতি নিয়েই আমাদের প্রেম করতে হত। কাছে আসার সুযোগ ছিল খুবই কম। টেলিফোন অফিসের কাছে আমার জেঠাতো বোনের বাড়ি ছিল লুকিয়ে মাঝেমধ্যে দেখা করার জায়গা। (চলবে)