ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে অবশেষে সোমবার (৫ই আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন শেখ হাসিনা। দুপুরে তিনি দেশ ত্যাগ করার পরপরই উত্তেজিত এবং আবেগপ্লুত মুক্তিকামী জনতা দলে দলে সংসদ ভবন ও গণভবনে প্রবেশ করতে শুরু করেন। বহু বছর ধরে জনগণের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা এক স্বৈরাচারী শাসকের পতনের পর স্বাভাবিকভাবেই উল্লাসে ফেটে পরেন মুক্তিকামী জনগণ। কেও কেও স্মৃতি হিসেবে সংসদ ও গণভবন থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে যান।
পরিস্থিতি বিবেচনায় বাহ্যিকভাবে এগুলোকে খুবই স্বাভাবিক মনে হলেও জাতীয় সংসদ ভবন ও গণভবনের ভেতরে প্রবেশ করে সেখানকার অবস্থা দেখে রীতিমতো আঁৎকে উঠার উপক্রম হয়! এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ভাঙচুর হয়নি। সবকিছু তছনছ করা হয়েছে। কোনোকিছুই স্বাভাবিক নেই।
ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সংসদ ভবন ও গণভবন থেকে বাহির হওয়ার প্রতিটি গেটে পাহারা বসিয়েছেন আন্দোলনে বিজয়ী ছাত্র-জনতা। তারা সবাইকে চেক করে করে তারপর ভেতর থেকে বের হতে দিচ্ছেন, যাতে কেও কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদ না নিয়ে যেতে পারেন। লুট হওয়া টাকাও উদ্ধার করে জমা দিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, লুটপাট-দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যবিহীন একটি শান্তিপূর্ণ কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করা যে শিক্ষার্থী-জনতার ব্রত, তারা কী এমন ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারেন? জাতীয় সম্পদের এমন ক্ষতি করতে পারেন? তবে কারা করলো এই ভাঙচুর, তছনছ।
এই ব্যাপারে বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কেও কেও বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী-জনতার সাথে ভেতরে ঢুকে যাওয়া টোকাই শ্রেণীর লোকেরা এসব ভাঙচুর করেছে। আবার কেও কেও বলছেন, এসব অপকর্ম করেছেন স্বয়ং সদ্য-ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগের লোকেরাই। তাদের দাবী, তারা একদম শুরুর দিকে ভেতরে প্রবেশ করেই দেখেন ভেতরের সবকিছু আগে থেকেই তছনছ করা। সকল শোকেস, ক্যাবিনেট ও আলমারির ড্রয়ার ছিল খোলা এবং ফাঁকা। গুরুত্বপূর্ণ সকল দলীল-দস্তাবেজ উধাও। তাদের মতে, পরবর্তী সরকার যেন দেশ চালাতে হিমশিম খায়, আর আওয়ামীলীগের এতদিনের কৃত দুর্নীতির দলীল-প্রমাণ না পায়; সেজন্যই ক্ষমতা ছাড়ার আগে পরিকল্পিতভাবে এসব অপকর্ম করে গিয়েছে তারা।
এই সংক্রান্তে একটি ফেসবুক পোস্ট ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। সেই পোস্টে লিখা হয়েছে, “জাতীয় সংসদে আমি আজকে ঢুকেছিলাম। পুরো সংসদ যেভাবে তছনছ করে রেখে গেসে সেটা অকল্পনীয়। অনেকেই বলবে ছাত্ররা লুট করেছে। আমি স্ট্রংলি তাদের ডিফেন্ড করবো। কয়েকটা পয়েন্ট তুলে ধরি কারো অযৌক্তিক মনে হলে জানাবেন। আমিও নতুন করে ভেবে দেখবো। আমি গণভবনে যাইনি তাই আমি শুধু জাতীয় সংসদের কথা বলবো।
১. আমি যে সময়ে সংসদ ভবনে গেসি তখন মাত্র ছেলেপেলে ঢোকা শুরু করসে। বেশ কিছু ছেলেপেলে তখন ঢুকে পড়সে মূলভবনের পাশের লাল বিল্ডিংয়ে। লাল বিল্ডিংয়ে আমিও প্রথমে ঢুকি। অনেকেই দেখলাম এটা সেটা নিচ্ছে কিন্তু পয়েন্ট টুবি নোটেড আমি কাউকে কিছু ভাংতে দেখি নাই। যে যা পারছে নেবার চেষ্টা করছে কিন্তু মার্ক মাই ওয়ার্ড কেউ তেমন কোনো ভাংচুর করেনি। (পরে অবশ্য বেশ কিছু ছাত্র গেটে প্রতিরোধ করায় অনেকেই আর কিছুই বের করতে পারেনি।
২. মূল সংসদ ভবনে ঢুকেই দেখি প্রত্যেকটা রুম তছনছ। আমি মুটামুটি ৫০+ রুম চেক করসি প্রত্যেকটা রুমের অবস্থা সেইম। এবং প্রতিটা রুমের কাঁচের যা যা ছিলো সেগুলা ভাঙা হয়েছে। ছাত্ররা যদি ভাঙে তাহলে তারা লুট করবে কখন? আর যদি ভেঙেও থাকে তাহলে এত সুন্দর করে কাজটা করলো কখন?আর লুট করেও বেশীরভাগ জিনিসই এক্সিট গেটে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে দিয়ে আসতে হয়েছে। আমি রাত দশটাতেও দেখে আসলাম প্রতিটা এক্সিটে ছেলেপেলে পাহাড়া বসিয়েছে। একটা বইও আনতে দিচ্ছেনা।
৩. যে সব টেবিল বা কাঁচের জিনিসপত্র ভাঙা হয়েছে সেগুলো সাধারণ বাঁশ বা লাঠি দিয়ে ভাঙা হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। মনে হয়েছে ভারী কিছু দিয়েই আঘাত করা হয়েছে। এবং ভেতরে আমি কারো হাতে লাঠি পর্যন্ত দেখিনি। আর কাঁচের টেবিলের প্রতি ছেলেপেলের ক্ষোভ আছে এ আমার মনে হয়না। এই ভারী যন্ত্র কেউ আলাদিনের চেরাগ ঘষে বের করলে হিসাব ঠিক আছে।
৪. একজন সংসদ সদস্য, একজন মন্ত্রী, বা একজন সচিবের টেবিলের ড্রয়ার অবশ্যই নান গুরুত্বপূর্ণ কাগজ থাকবে। এবং সেটার চাবি অবশ্যই ড্রয়ারের সাথে ঝুলবে না। আমি এমন একটা ড্রয়ার পাইনি যেটা আটকানো ছিলো। সবগুলো খোলা এবং প্রায় ফাঁকা ছিলো। একজন মন্ত্রীর টেবিলের চাবি অবশ্যই ছেলের হাতের মোয়া না। সেখানে প্রতেকটা ড্রয়ার খোলা পেয়েছি। আবারো বলছি প্রত্যেকটা।
৫. শুধু টেবিল না, প্রতেকটা রুমের আলমারি, লকার সব খোলা ছিলো। সব লুট করা ছিলো। এসব আলমারিতে তালা দেয় না কেনো? আমার মা তো আলমারি ভর্তী লেপ-কাঁথা রেখেও আলমারিতে তালা দিয়ে সেই চাবি বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমায়। কিজানি আমাদের এমপি, মন্ত্রীরা হয়তো এসবে উদাসীন ছিলো।
৬. আমি মোটামুটি ৩০+ সিপিইউ পাইসি কম্পিউটারের যেগুলোর একটাতেও র্যাম,হার্ড্ডিস্ক আর প্রসেসর ছিলোনা। এবং সেগুলো এলোপাতাড়ি ছড়ানো ছিলো এখানে সেখানে। আমি প্রথম কয়েকটা চেক করার পর আমার খটকা লাগে এবং আমার সাথের একজনকে নিয়ে পাগলের মতো খুঁজতে থাকি বিশ্বাস করেন আমি একটা পিসিতেও র্যাম,হার্ডডিস্ক বা প্রসেসর পাইনি।
৭. সংসদ ভবন বিল্ডিংটা এতো বড় আর গোলকধাঁধার মতো যে আপনি একই রুমে সেচ্ছায় দুইবার যেতে পারবেন না। আমি প্রথমে ছাদে গিয়ে আর ছাদে যাবার রাস্তা পাইনি। এমনকি মূল অধিবেশন যেখানে হয় সেটা অনেক উপর থেকে দেখেছি কিন্তু নিজে যেতে পারিনি। আর সেখানে নতুন একটা বিল্ডিংয়ের সব রুম এভাবে আউটসাইডাররা তছনছ করে ফেললো ব্যাপারটা বুঝতে ফেলুদা হওয়া লাগেনা।
৮. প্রতিটা রুমের আলমারি বা শোকেস ফ্লোরে ফেলে রাখা ছিলো। আলমারির দরজা খোলা, শোকেসের দরজা খোলা। পুরো রুমে কাগজের ছড়াছড়ি। অথচ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাগজই দেখলাম না। সবই খুবই নরমাল কাগজ, খাম আর নিজেরদের কিছু বই। আর হ্যা প্রচুর এ ফোর পেপার।
এখন আমি ভুল হতেই পারি। কিন্তু মাত্র দুই-তিন ঘণ্টায় পুরো সংসদ ভবন ভাংচুর করে একাকার করে দেওয়া ছাত্রদের পক্ষে কতটুকু সম্ভব সেটা বুঝতে মনে হচ্ছে আমার রকেট সাইন্স জানার দরকার নাই।
একদল জানোয়ার এসব এতোদিন ভোগ করেছে এবং পালানোর আগে সব মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেছে যাতে চাইলেও খুব অল্পদিনে এই সংস্কার করা না যায়। এতো গেলো সংসদ ভবনের কথা। দেশটার কি করে রেখে গেছে সেটা হয়তো আমাদের সময়ই বলে দিবে।
পোস্টদাতা আরো দাবী করেন, তাদের কাছে প্রমাণ হিসেবে অনেক ছবি ও ভিডিও রয়েছে। সময়মতো সেগুলো তারা প্রকাশ করবেন।
তবে বাস্তবে যাই ঘটে থাকুক না কেন, শেখ হাসিনার ইস্তফা এবং দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিশ্চিত হওয়ার পর কেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সংসদ ভবন ও গণভবনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টা করা হলো না, সে এক বড় প্রশ্ন।