বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০১:২৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
২৩০ আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশ মানুষের কল্যাণে ডিএসসিএসসি’র প্রশিক্ষণার্থীদের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগানোর আহ্বান রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পদত্যাগপত্র গৃহীত অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে ইসি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে: সিইসি নির্বাচনে বাধা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা নীরব কেন : প্রশ্ন ওবায়দুল কাদেরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে শেখ হাসিনা, ডাক ও টেলিযোগাযোগে পলক ডা. এনামুর মনোনয়ন ফরম জমা দিলেন আজ মনোনয়নপত্র দাখিল করলেন নিক্সন ধর্ষক সালাউদ্দিনের বিচারের দাবিতে সাংবাদিক সম্মেলন ফরিদপুরের দুইটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোট করার ঘোষণা  আজাদ ও দোলনের

আব্দুর রহমানের জন্মদিন এবং কিছু স্মৃতি

জোহরা খাতুন
  • আপডেট সময় : 7:25 pm, সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৩

আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে যাই। সব ঘটনা আমাদের মনে দাগ কাটে না, স্মৃতিতে ঠিক তুলে রাখার মতো হয় না। আবার এমনও কিছু কিছু ঘটনা থাকে যেগুলো বিভিন্নভাবে আমাদেরকে আন্দোলিত করে, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে। আমাদেরকে মানবিক হতে শেখায়, আনন্দ ভাগাভাগি করতে শেখায়। নির্ধারিত দায়িত্ব-কর্তব্যের বাইরে এসে জীবন উদ্‌যাপন করতে শেখায়।

২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখের একটি ঘটনা। সিংগাইর উপজেলার শায়েস্তা ইউনিয়নের সাহরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি (এসএমসি)’র পূর্ব নির্ধারিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) দিপন দেবনাথ। উপজেলা থেকে সাহরাইলের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময় তিনি আমাকে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। সে অনুযায়ী আমি তার সফরসঙ্গী হলাম। যথারীতি সভা অনুষ্ঠিত হলো। সভা শেষে স্কুল ত্যাগ করার আগে তিনি স্কুল প্রাঙ্গণে দাঁড়ানো কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে তাদের সন্তানের বিষয়ে কথা বললেন। গাড়িতে উঠেই তিনি আশপাশের আরও কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি তাকে সাহরাইলের খুব নিকটেই পূর্ব সাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বিষয়ে বললাম। তিনি রাজী হলেন।

পূর্ব সাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছুতেই দেখি ছাত্র-ছাত্রীরা জাতীয় সংগীত সমাবেশের জন্য দাঁড়িয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার গাড়ি থেকে নেমেই বাচ্চাদের সঙ্গে সমাবেশে দাঁড়িয়ে পড়লেন, গলা ছেড়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন, হাত তুলে বাচ্চাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ার শপথ পাঠ করলেন। সমাবেশ শেষে শিক্ষার্থীরা তাদের নির্ধারিত ক্লাসে চলে গেলে তিনি স্কুল প্রাঙ্গণে দাঁড়ানো কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ করতে লাগলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিলেন। অভিভাবকদের মধ্যেই এক মায়ের কোলে একটি শিশু অস্বাভাবিকভাবে কাঁদছিল। জিজ্ঞেস করতেই বাচ্চাটির মা জানালো জন্মের পর থেকেই সে বাইরে এলে অস্বাভাবিকভাবে কান্না করে। এলাকার ডাক্তার দেখিয়েছে, খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। দেখে মনে হলো বয়সের তুলনায় গ্রোথও কম। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাচ্চাটির মা’কে চান্দহর ইউনিয়নের শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিতব্য অটিজম ও অন্যান্য নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজ-অর্ডার যাচাই ক্যাম্পে নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানালেন। ততক্ষণে শ্রেণি পাঠদান শুরু হয়ে গেছে। আমি আগেও দেখেছি, ইউএনও স্যার কোনো স্কুলে গেলে অন্তত একটা ক্লাস নিতে পছন্দ করেন। কারণ তিনি নিজেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। 

আমরা গেলাম পঞ্চম শ্রেণির একটি ক্লাসে। শ্রেণিশিক্ষক মৌসুমী আক্তার ইংরেজি পড়াচ্ছেন। পাঠের বিষয় ‘বার্থডে সেলিব্রেশন’। শ্রেণিশিক্ষকের অনুমতি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজেই ক্লাসটি পরিচালনা করতে লাগলেন। বিভিন্ন দেশের জন্মদিন পালনের রীতিগুলো নিয়েও তিনি গল্প করলেন। এরপর তিনি শিক্ষার্থীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তারা কে কীভাবে জন্মদিন পালন করে। সবাই যার যার মতো করে বললেও, সামনের বেঞ্চের একটি ছেলে শুরু থেকেই কোনো কথা বলছিল না। বিষয়টি তার দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি ছেলেটির পাশে এসে নাম জানতে চাইলেন। ইতস্তত দাঁড়িয়ে খুব ছোট গলায় ছেলেটি বললো, আব্দুর রহমান। এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো আব্দুর রহমান, তুমি কীভাবে তোমার জন্মদিন পালন কর?’ প্রশ্নটা শুনেই ছেলেটি একটু বিমর্ষ হলো। বললো, ‘স্যার, আমি কখনো জন্মদিন পালন করিনি।’ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবার জানতে চাইলেন, ‘তোমার জন্মদিন পালন করতে ইচ্ছে করে না? ছেলেটি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালো। তাহলে পালন করে না কেন তা জানতে চাইলে ছলছল চোখে ছেলেটি বলে, ‘এমনিতেই!’ খুব ব্যথিত হলেন তিনি। ক্লাসের মধ্যে কেমন জানি একটা নীরবতা চলে আসলো। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বুঝলেন কিছু একটা বিষয় আছে যা ছেলেটি বলতে চাইছে না। 

শ্রেণি শিক্ষক মৌসুমী আক্তার জানালেন আব্দুর রহমানের বাবা কহিনূর ইসলাম এবং মা কাঞ্চন মালা। দুজন’ই মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। সে তার দাদা-দাদির কাছে থাকে। তবে সে তার জন্মদিন মনে রাখে। জিজ্ঞেস করতেই সে বললো, ‘৫ অক্টোবর’। হিসেব করে দেখা গেলো মাত্র এক সপ্তাহ পরেই তার জন্মদিন। এবার উপজেলা নির্বাহী অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন কে?’ একটি মেয়ে দাঁড়ালো। নাম তার তৃষা আকতার। উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাকে বললেন, ‘শোনো তৃষা, তোমাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই। আমি চাই তুমি তোমার ক্লাসের বন্ধুদের নিয়ে ৫ অক্টোবর আব্দুর রহমানের জন্মদিন পালন করবে। হ্যাড স্যার এবং মৌসুমী ম্যাডাম তোমাকে সাহায্য করবেন। কী, পারবে না?’ মেয়েটি খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, জ্বি স্যার পারবো। পরম মমতায় তিনি আব্দুর রহমানের মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, ‘তোমার জন্মদিন আমাদের সবার জন্য বিশেষ একটা দিন। তাই আমরা সবাই মিলে তোমার জন্মদিন পালন করবো।’ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে তিনি প্রধান শিক্ষক মোঃ সাঈদুর রহমানের কক্ষে গেলেন। হ্যাড স্যারকে কিছু টাকা দিয়ে আব্দুর রহমানের জন্মদিন উদ্‌যাপনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেন। এবং আরও বললেন, যদি সেদিন কোনো জরুরি কাজ না থাকে তবে তিনি এই জন্মদিনে উপস্থিত থাকবেন।

৫ অক্টোবর ২০২৩। সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, কিছুটা বৈরি আবহাওয়া। তবুও পূর্ব সাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির উপস্থিতি শতভাগ। সবার খুশিমুখ, কারণ আজ তাদের বন্ধু আব্দুর রহমানের জন্মদিন। তৃষার নেতৃত্বে সাজানো হলো শ্রেণিকক্ষ। কেক আনা হলো। সাথে মোমবাতিও। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আব্দুর রহমানকে দেওয়া হলো ফুল। ক্লাসের কিছু বন্ধু চকলেটও নিয়ে এসেছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কাঁটা হলো। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে গাইলেন, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’। লজ্জা-আনন্দের মিশেলে আব্দুর রহমানের মুখছবি যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। জীবনে প্রথমবারের মতো জন্মদিন উদ্‌যাপনের অনুভূতি সম্ভবত এমনই। শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে কেক খেলো। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে উদ্‌যাপিত হয়ে গেলো আব্দুর রহমানের জীবনের প্রথম জন্মদিন আর সৃষ্টি হলো কিছু অমূল্য স্মৃতি। কাকতালীয়ভাবে সেদিন ছিল বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকবৃন্দ নির্দ্বিধায় বললেন, আব্দুর রহমানের জন্মদিন উদ্‌যাপন তাদের শিক্ষকতা জীবনের অন্যতম সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকবে।

আব্দুর রহমান তার জীবন চলার পথে পরেও হয়তো অসংখ্যবার জন্মদিন উদ্‌যাপন করবে। অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর শুভাশিসে ভরে উঠবে তার ভবিষ্যৎ জীবন। কিন্তু সে মনে রাখবে তার প্রথম জন্মদিন উদ্‌যাপন। সে এই প্রেরণা নিয়ে বড় হবে যে পৃথিবীতে কেউ কখনোই একা নয়। দীর্ঘ একুশ বছরের চাকুরী জীবন শেষে আমিও জানলাম, ছোট্ট একটা আয়োজন কারো কারো জীবনের শ্রেষ্ঠ আয়োজনের শুভ সূচনা। শিখলাম, আমাদের চারপাশেই এমন অনেকেই আছে যাদের জীবনের গল্প ভিন্ন গল্প হতে পারতো আমাদের কারো কারো একটু ছোঁয়াতেই। আমাদের অনেকেরই জীবন কেনলই চাকুরে জীবন, আবার এমন অনেক ব্যতিক্রমী আছেন যাদের জীবন ঠিক চাকুরে জীবন নয়, ভীষণরকম ভিন্ন জীবন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই রকম আরো জনপ্রিয় সংবাদ
© All rights reserved © 2017 Cninews24.Com
Design & Development BY Hostitbd.Com