নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আনন্দ আয়োজন, উৎসব ও খেলাধুলা সবকিছুতেই নদী ও নৌকার সরব আনাগোনা। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংস্করণ বাংলাদেশের নৌকা বাইচ। একসময় এদেশে যোগাযোগ ছিল নদী কেন্দ্রিক আর বাহন ছিল নৌকা। এখানে নৌ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বিভিন্ন শিল্প কেন্দ্র। এসব শিল্পে যুগযুগ ধরে তৈরি হয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগর। এভাবে একসময় বিভিন্ন নৌযানের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকা বাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল বলে জানা গেছে। অনেকে মনে করেন, নবাব বাদশাহদের নৌবাহিনী থেকেই নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা বাইচ লোকায়ত বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। তবে কবে এদেশে গণ বিনোদন হিসেবে নৌকা বাইচের প্রচলন হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়না। “বাইচ” শব্দটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করে অনুমিত হয়েছে যে মধ্যযুগের মুসলমান নবাব, সুবেদার, ভূস্বামীরা, যাদের নৌবাহিনী, তারা এই প্রতিযোগিতামূলক বিনোদনের সূত্রপাত করেছিলেন। তবে এবিষয়ে দুটি জনশ্রুতি আছে।
১. একটি জনশ্রুতি জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রাকে কেন্দ্র করে। জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা যাত্রীরা প্রতিযোগিতার আনন্দ পায়। এথেকে কালক্রমে নৌকা বাইচের শুরু।
২. দ্বিতীয় জনশ্রুতি পীর গাজীকে কেন্দ্র করে। আঠারো শতকের শুরুর দিকে কোন এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা তা ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। কিন্তু ঘাটে কোন নৌকা ছিলনা। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখনই নৌকাটি মাঝনদীতে এলো তখনই নদীতে তোলপাড় আরম্ভ হল। নদী ফুলে ফেঁপে উঠলো। তখন চারপাশের যত নৌকা ছিল তারা খবর পেয়ে ছুটে আসেন। তখন সারি সারি নৌকা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। এ থেকেই নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়।
নৌকা বাইচকে উৎসাহ প্রদান ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার লক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশে জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে প্রধানত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার দূরত্ব ৬৫০ মিটার। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের নৌকা বাইচের উন্নয়নের জন্য ‘বাংলাদেশ বোয়িং ফেডারেশন’ গঠিতহয়। সনাতন নৌকাবাইচ ও বোয়িং এরমধ্যে সমন্বয় সাধন করাই বাংলাদেশ বোয়িং ফেডারেশনের কাজ। এ ফেডারেশনটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বোয়িং ফেডারেশনের সদস্য। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে একটি আন্তর্জাতিক নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
নৌকায় ওঠার আবার অনেক আনুষ্ঠানিক তা রয়েছে। সকলে পাক-পবিত্র হয়ে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল/গামছা বেধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক যিনি দাঁড়িয়ে থেকে নৌকা চালান। পেছনের মাঝিরা। প্রতিটি নৌকায় ৭, ২৫, ৫০ বা ১০০ জন মাঝি থাকতে পারেন।
উপযুক্ত নৌকায় দু’পাশে মাঝিরা সারবেধে বসে পড়ে বৈঠাহাতে। মাঝিদের বৈঠা টানাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য একজন পরিচালক থাকে যাকে বলা হয় গায়েন। সে বসবে নৌকার গলুই-এ।। মাঝিরা একত্রে জয়ধ্বনি সহকারে নৌকা ছেড়ে দিয়েই একসাথে কোনো একটি গান গাইতে আরম্ভ করে এবং সেই গানের তালের ঝোঁকে ঝোঁকে বৈঠা টানে ; যার ফলে কারও বৈঠা ঠোকা ঠুকিনা-লেগে একসাথে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসির শব্দে এই বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টায় প্রয়োজন বোধে কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয় এবং সেই সাথে গানের গতিও বেড়ে চলে। এছাড়া এই সময় দেহ ও মনের উত্তেজনার বশেই গানের মধ্যে ‘হৈ, হৈয়া” এই ধরনের শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। এটি সারি গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকা দেখা যায়। বাইচের নৌকার গঠন কিছুটা বৈজিত্রপূর্ণ। এই নৌকা হয় সরু ও লম্বাটে। লম্বায় যেমন অনেক দিঘল ; ঠিক তেমনই চওড়ায় খুবই সরু। কারণ সরু ও লম্বাটে হওয়ার দরুন নদীর পানি কেটে দর তরিয়ে দ্রুত চলতে সক্ষম এবং প্রতিযোগিতার উপযোগী। নৌকার সামনের গলুইটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। তাতে কখনো করা হয় ময়ূরের মুখ, কখনো রাজহাঁস বা অন্যকোনো পাখীর মুখা বয়ব। নৌকাটিতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয়। সর্বোপরি নৌকাটিকে দর্শকের সামনে যথা সম্ভব আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা থাকে।
কারুকার্য ও গঠনের দিকে তাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাইচের নৌকা গুলোর মধ্যে বৈচিত্র্যতা দেখা যায়। একেক অঞ্চলের নৌকা বাইচের জন্য একেক রকমের নৌকার প্রচলন রয়েছে। ঢাকা, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ এ অঞ্চলগুলোতে বাইচের জন্য সাধারণত কোশা নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর গঠন সরু এবং লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। কোশা নৌকার সামনের ও পেছনের অংশ একেবারে সোজা। কোশা নৌকা তৈরিতে শাল, শীল কড়ই, চাম্বুল ইত্যাদি গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। টাঙ্গাইল ও পাবনায় নৌকা বাইচে সরু ও লম্বা ধরনের ছিপ জাতীয় দ্রুত গতি সম্পন্ন নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর গঠন ও সাধারণত সরু এবং লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। এর সামনের দিকটা পানির সাথে মিশে থাকে আর পেছনের অংশটি পানি থেকে প্রায় ৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। এই নৌকায় সামনের ও পেছনের মাথায় চুমকির বিভিন্ন কারুকার্য থাকে। ছিপ জাতীয় বাইচ নৌকা তৈরিতে ও শাল, গর্জন, শীল কড়ই, চাম্বুল ইত্যাদি গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আজমিরিগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে বাইচের জন্য সারেঙ্গী নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর আকার ও কোশা ও ছিপ জাতীয় বাইচ নৌকার মত ইসরু লম্বায় প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট তবে এরপ্রস্থ একটু বেশি ৫ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত হয়। এর সামনের ও পেছনের দিকটা পানি থেকে দু-তিন ফুট উঁচু থাকে এবং মুখটা হাঁসের মুখের মতো চ্যাপ্টাহয়। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার নিম্নাঞ্চল ও সন্দ্বীপে বাইচের জন্য সাম্পান ব্যবহৃত হয়। সাম্পান দেখতে জাহাজের মতো। ঢাকা ফরিদপুরে ব্যবহৃত হয় গয়না নৌকা। গয়না দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০০ ফুট থেকে ১২৫ ফুট মাঝখানে ৮ থেকে ৯ ফুট প্রশস্ত। এর সামনের দিকটা পানি থেকে ৩ ফুট ও পেছনের দিকটা পানি থেকে ৪, ৫ ফুট উঁচু হয়।
বাইচের নৌকা গুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন, ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, পাতাম, বাচারি, ঘাসি ইত্যাদি নৌকা বাইচে অংশ নেয়। একেকটি লম্বায় প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ফুট হয়। নৌকার সামনে সুন্দর করে সাজানো হয় এবং ময়ুরের মুখ, রাজহাঁসের মুখ বা অন্য পাখির মুখের অবয়ব তৈরি করা হয়। দর্শকদের সামনে দৃষ্টিগোচর করতে নৌকা উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করা হয়। গায়না তরী, সোনার চান, মায়ের দোয়া, হারানো মানিক, দুই ভাই, সোনার বাংলা, রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ, হাজারী তরী, আল্লাহর দান, শোকচাঁন তরী, অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খীরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুন, তুফানমেইল, জয়নগর, চিলেকাটা, , দীপরাজ ইত্যাদি নামকরণ করা হয় নৌকাবাইচের নৌকার।
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় মানিকগঞ্জে নৌকা বাইচ
বর্ষা মৌসুমের আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মানিকগঞ্জ শহরের বেউথা ও ঘোস্তা এলাকায় কালিগঙ্গা নদীতে, ঘিওরের কান্তাবতী নদী, কালীগঙ্গা, দৌলতপুরে যমুনা নদী, ঝিটকায় ইছামতি নদীতে, আরুয়া ইউনিয়নের দড়িকান্দি-নয়াকান্দি ইছামতি নদীতে, হরিরামপুর উপজেলার সাপাই দিয়াবাড়ীবিল, দৌলতপুর উপজেলায় সমেদপুর গ্রামে ইছামতি নদীতে, সিংগাইর উপজেলায় চান্দহরে ধলেশ্বরী, বলধারা রামকান্তপুর এবং ঘিওর উপজেলায় পেঁচারকান্দা-কুশুণ্ডা-জাবরা এলাকায়, বালিরটেক কালিগঙ্গা নদীতে নৌকা বাইচের আয়োজন চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয় এসব নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা ।
প্রতিযোগিতায় মানিকগঞ্জ ও আশপাশের জেলা থেকে কমপক্ষে অর্ধশত নৌকা অংশ নেয়। স্থানীয় সরদার সমিতির আয়োজনে অনুষ্ঠিত নৌকাবাইচ উপভোগ করেন হাজার হাজার দর্শক। নদী তীরের কমপক্ষে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পরিণত হয় মানুষের মিলন মেলায়। নৌকার ওপর ভাসমান দোকানপাটে বাহারি পণ্যের বেচাকেনার ধুম পড়ে যায় এ সময়।নদী আর নৌকা বাইচের সাথে মানিকগঞ্জের মানুষের আশৈশব মিতালি। নদী এখানকার মানুষের প্রাণোচ্ছল ক্রীড়াসঙ্গী। পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, কান্তাবতী বংশী বিধৌত মানিকগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য, উৎসব সবকিছুতেই নদী ও নৌকার সরব উপস্থিতি। নৌকা বাইচ এ অঞ্চলের প্রাচীন সংস্কৃতির একটি অংশ। কিন্তু বর্তমানে বাঙালির প্রাচীন এই ঐতিহ্য ম্লান হতে বসেছে। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রাচীন এ সংস্কৃতির অনুষঙ্গ টিকে থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ও নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নৌকা বাইচ বিভিন্ন নামে পরিচিত। ড্রাগন বোটরেস, সোয়ান বোটরেস, রোয়িং বোটরেস, কেনীয় ও কাইয়াক বোট রেস ইত্যাদি নামে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে।