আনন্দঘন পরিবেশে কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া মাঠে অনুষ্ঠিত হলো দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত। এই জামাতে লক্ষাধিক মুসল্লি অংশ নেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। এটি ছিল শোলাকিয়ায় ঈদুল আজহার ১৯৫তম জামাত। কঠোর নিরাপত্তায় আজ রবিবার সকাল ৯টায় শুরু হয় ঈদের এই জামাত।
এতে ইমামতি করেন মাওলানা হিফজুর রহমান।
নামাজ শেষে যুদ্ধবিগ্রহ ও করোনামুক্ত পৃথিবী, দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
নামাজ শুরুর আগে মুসল্লিদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন ঈদগাহ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম, পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ ও পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ।
ঈদের জামাতকে সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ রাখতে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয় শোলাকিয়া ও আশাপাশের এলাকা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চার স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে মুসল্লিদের ঢুকতে হয় ঈদগাহ মাঠে। কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে হাসিমুখে সহযোগিতা করতে দেখা যায় মুসল্লিদের। তবে করোনা সংক্রমণ বাড়ার পরও স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি ছিল অনেকটাই ঢিলেঢালা। মাস্ক পরে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মাঠে প্রবেশের নির্দেশনা থাকলেও অনেককে মাস্ক ছাড়াই মাঠে যেতে দেখা গেছে।
২০১৬ সালে জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে শোলাকিয়ায় নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। ঈদগাহ মাঠের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দুই প্লাটুন বিজিবি, বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যের সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। একই সঙ্গে মাঠে সাদা পোশাকে নজরদারি করেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তা ছাড়া মাথার ওপরে ওড়ে পুলিশের ড্রোন ক্যামেরা। শোলাকিয়া মাঠ ও শহরসহ প্রবেশপথগুলো সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। মাঠে স্থাপিত ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার থেকে দুরবিন ও স্নাইপার রাইফেল নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। শোলাকিয়া এলাকা ও শহরের যত অলিগলি আছে, সবখানে বসানো হয় নিরাপত্তাচৌকি।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, এবার নিরাপত্তা নিয়ে কোনো হুমকি ছিল না। তার পরও শোলাকিয়ার গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে চার স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এখানে নামাজ পড়তে এসে মুসল্লিরা যেন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় না থাকেন এবং তাদের মধ্যে কোনো অস্বস্তি না থাকে সেভাবেই তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে।
ভোর থেকেই শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের দিকে যেতে থাকেন মুসল্লিরা। কেউ গাড়িতে চড়ে, কেউ ইজি বাইকে, কেউ সাইকেলে, কেউ বা হেঁটে। সকাল ৯টার আগেই ভরে যায় শোলাকিয়া মাঠ। প্রতিবারের মতো এবারও মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধায় দুটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে রেল কর্তৃপক্ষ। একটি ট্রেন ভৈরব থেকে, অন্যটি ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জে যায়। ঈদগাহ এলাকায় কয়েকটি মেডিক্যাল টিম ও ফায়ার সার্ভিসের একটি দল মোতায়েন ছিল। স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে ছিল বিপুলসংখ্যক স্কাউট সদস্য।
শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে নামাজ সম্পন্ন হওয়ায় মুসল্লিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, লক্ষাধিক মুসল্লি এবার শোলাকিয়ায় ঈদুল আজহার নামাজ পড়েছেন। ঈদগাহ কমিটির পক্ষ থেকে আগত মুসল্লিদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে যে আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল, তা সত্যি মুগ্ধ হওয়ার মতো।
কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, ‘দিনরাত পরিশ্রম করে পৌরসভার পক্ষ থেকে মাঠটি নামাজের উপযোগী করা হয়। তা ছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ছিলাম। ‘
জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও পৌর মেয়র ছাড়াও গণ্যমান্য লোকজন শোলাকিয়ায় নামাজ পড়েন।
শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ উপলক্ষে শহরের মোড়ে মোড়ে নির্মাণ করা হয় শুভেচ্ছা তোরণ। রাস্তার দুই পাশে টানানো হয় রংবেরঙের পতাকা ও ব্যানার। সব মিলিয়ে কিশোরগঞ্জে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে।
জনশ্রুতি আছে, ১৮২৮ সালে এই মাঠে ঈদের নামাজে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছিলেন। সেই থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখিয়া’। যা এখন শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ নামে পরিচিতি পেয়েছে।