স্টাফ রিপোর্টার:
ঢাকার সাভার, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাকরী প্রতারণা ও ভূমি জালিয়াতি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে কথিত এক জমিদার পুত্রের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তাঁর নামে প্রতারনার অভিযোগে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হলে প্রতারক আত্মগোপনে রয়েছে।
ভূক্তভোগী অনেকেই জানান, টাঙ্গাইলের জমিদার পরিবারের ছেলে পরিচয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার বোয়ালী কাপাসিয়া চালা গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দিনের ছেলে নাসির উদ্দিন ফরহাদ নিজেকে জমিদারী অনেক সম্পত্তির মালিক বলে জালিয়াতি করে অনেকের অর্থ হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও সে বরিশালের পায়রা বন্দরে চাকরী দেয়ার নামে শত শত লোকের কাছে প্রায় কয়েক কোটি টাকা নিয়ে ভূয়া নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দিয়ে প্রতারণা করে। নাসিরের প্রতারণার শিকার অনেককেই এখন অর্থ-বৃত্ত হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
নাসির উদ্দিন ফরহাদের মামা পরিচয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার সাটিয়াচরা গ্রামের আব্দুর রহিম মুকুল বলেন, নাসির ২০১৮ সালে বরিশালের পায়রা বন্দরে চাকরী দেয়ার চুক্তি নিয়েছে বলে জানায়। এরপর মুকুল তার ভাই আবুল বাশার ও ভগ্নিপতি মো: মোস্তাক হোসেনসহ অনেকের পায়রা বন্দরে চাকরী দেয়ার জন্য দলিলে অঙ্গীকার করে ১৬ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর ভূয়া নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড সরবরাহ করে নাসির। এদেরসহ প্রায় ৫০ জনকে রাতের বেলা ট্রলারে করে পটুয়াখালী বিষখালী নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখান থেকে একটি জাহাজের কাছে ফেলে চলে যায় প্রতারক চক্র। এ ব্যাপারে ২০১৯ সালে টাঙ্গাইল সিনিয়র জুডিসিয়াল কোর্ট আমলী আদালতে আব্দুর রহিম মুকুল বাদী হয়ে নাসির ও নাসিরের স্ত্রী-ভাইসহ চারজনের নামে মামলা দায়ের করেন। সে মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। এরপর থেকে নাসির এলাকা থেকে আত্মগোপনে চলে যায়।
রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের দিকে নাসির উদ্দিন ফরহাদ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে চাঁদ উদ্যান হাউজিংয়ে বসবাস করতো। সেখান থেকে জমি জালিয়াতি চক্র গড়ে তুলে বিভিন্ন লোকের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেয়। গাজীপুরের হাইটেক পার্কের জমির কথা বলে নাসিরের জালিয়াতের শিকার অনেকের মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুরের ভোলার অধিবাসী এটু জেড ইলেকট্রনিক্সের সত্ত¡াধীকারী মহিউদ্দিনের কাছ থেকে ১১ লক্ষ টাকা, মোহাম্মদপুরের ওয়েলডিং মিস্ত্রি নোয়াখালীর আবিরের কাছ থেকে ৯ লক্ষ টাকা, ঠিকাদার লক্ষিপুরের রুবেলের কাছ থেকে ৭ লক্ষ টাকা, মোহাম্মদপুরের এটু জেড ইলেকট্রনিক্সের ম্যানেজার সাইফুলের কাছ থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার গোড়াই এলাকার কালামের সাড়ে তিন লাখ এবং একই এলাকার সাহাদাতের সাড়ে চারলাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
সে সময় তাঁর প্রতারনার বিষয়টি বুঝতে পেরে ভুক্তভোগী সকলে নাসিরের কাছে অর্থ ফেরৎ চাইলে সে তাঁর তৃতীয় স্ত্রী স্মৃতিকে নিয়ে পালিয়ে সাভারে চলে আসে। এখানে এসে নতুন করে জমি বিক্রি করে কোটি টাকার স্মপ্ন দেখিয়ে সে সর্বশান্ত করে মাসুদ রানা, দুলালসহ অনেককে।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার বারিন্দা বাজারের দোকানের জমি ক্রয় করে দেয়ার কথা বলে একই বছর নাসির উদ্দিন ফরহাদ চা দোকানী বাদশার কাছ থেকে ৮০ হাজার নিয়ে আত্মসাৎ করেন।
বরিশালের পায়রা বন্দরে চাকরী দেয়ার নামে আরো যাদের টাকা নাসির আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে ঢাকার সাভারের শফিক চার লাখ, টাঙ্গাইল দরুনের তারেক ৪ লাখ, টাঙ্গাইলের আলাউদ্দিনের কাছ থেকে ৭০ হাজার, নজরুলের ৮০ হাজার টাকা, মির্জাপুর থানার ফতেপুর গ্রামের আল মামুনের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা, দেলদুয়ারের হামিদের কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ঘাটাইলের টুটুলের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
পিএসকেএফ- পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের হাসপাতাল করার নামে সাংগঠনিক সম্পাদকের পরিচয়ে সংগঠনে পদ-পদবী ও শেয়ার বিক্রি করার নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় নাসির উদ্দিন ফরহাদ। এমনি অভিযোগ করেছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুল ইসলাম।
আরো জানা গেছে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাসপাতাল করার নামে মিরপুরের সালামের কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় নাসির।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার বোয়ালী গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত নাসির উদ্দিন ফরহাদ ও তাঁর সিন্ডিকেট। কেউ তাঁর অপকর্মের প্রতিবাদ করলে তাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয় সে। তাঁর নিজস্ব নারীদের ব্যবহার করে অনেককে হুমকী ধামকী দেয় নাসির। যে কারণে মান-সম্মান বাঁচাতে তার অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে অনেকেই নিরবে সহ্য করে যাচ্ছেন বাস্তবতা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের অনেকেই জানান, নাসিরের প্রধান সহযোগী আব্দুল আজিজ ঢাকাতেই বসবাস করে নিজেকে ওসির ভাই পরিচয় দেয়। সে সকল অপকর্মে জড়িত থেকে ভুক্তভোগীদের উপর নানাভাবে অত্যাচার করে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরের নিজ গ্রামে অপরের জমি দখল, হত্যা, গুমসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়েও সেই তথ্য মিলেছে নাসিরের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় নাসিরের বিরুদ্ধে থানায় জিডি ও মামলা হয়েছে।
সূত্র মতে, মামা মুকুলের দেয়া মামলায় সম্প্রতি নাসির উদ্দিন ফরহাদের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা দেয় টাঙ্গাইল সিনিয়র জুডিসিয়াল কোর্ট আমলী আদালত। গত ২০ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ নাসিরের বর্তমান পালিয়ে থাকা সাভারের বাসায় অভিযান চালালেও জানা যায়, সে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হওয়ার কারণে প্রায় ১ মাস বাসায় আসছেন না।
নাসিরের ২ য় স্ত্রী রেখা ওরফে রুমাকে এফিডেফিডের মাধ্যমে বিয়ে করে ৯ বছর সংসার করার পর তাঁকে চলে যেতে বাধ্য করে। এরপর বর্তমান ৩য় স্ত্রী স্মৃতিকে বিয়ে করে প্রথমে মোহাম্মদপুর ও পরে সাভারে এনে রাখে।
নাসিরের অপকর্মের প্রতিবাদ করায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার সাভারের অনেকেই তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর হুমকীর মুখে রয়েছেন।
সাভারের বাড়ীর মালিক ও এলাকার মুদী দোকানীরাও পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে অশ্লিল আচরণ ও হুমকীর শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাসির উদ্দিন ফরহাদ ও তা^র সিন্ডিকেটের এধরনের প্রতারণা বন্ধ করতে পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দা সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ভুক্তভোগীরা।