জাকাত ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার দ্বারা রাষ্ট্র ও মানুষের একটি বড় অংশ উপকৃত হয়। রাষ্ট্রের আর্থিক প্রয়োজনীয়তা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে ইসলামের সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে। যতক্ষণ না সমাজে সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে চালু হবে, ততক্ষণ ইসলামী অর্থনীতির তাৎপর্য বোঝা যাবে না এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সব চাহিদা পূরণ করাও সম্ভব হবে না।ৃ
জাকাত ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের ওপর—এক. এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল, দুই. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা, তিন. জাকাত প্রদান করা, চার. কাবাগৃহের হজ করা এবং পাঁচ. রমজান মাসে রোজা পালন করা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮)
ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো নামাজ ও জাকাত। জাকাতের গুরুত্ব বোঝার জন্য এটিই অনুমেয় যে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে একসঙ্গে নামাজ ও জাকাতের আলোচনা ৩২ বার উল্লেখ করেছেন। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২০২)
জাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়টি কোরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দাও।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৪৩)
এ আয়াতে জাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট। আর জাকাত দ্বিতীয় হিজরিতে রোজার আগে ফরজ করা হয়েছে। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২০২)
যেহেতু জাকাতের ফরজ হওয়ার বিষয়টি কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা প্রমাণিত, তাই যে তা অস্বীকার করবে সে কাফের।
তবে জাকাত আদায়ের কথা অস্বীকার করলে সে কাফের হবে না; ফাসেক হবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৬৮)
অনুরূপভাবে জাকাত ফরজ হওয়ার ব্যাপারে বহু হাদিস আছে। এর মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো :
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই ও মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল আর নামাজ কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে। (বুখারি, হাদিস : ২৫)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পরে কুরাইশরা তাদের সম্পদের জাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪০০)
সুতরাং প্রতীয়মান হয় যে ইসলামের কোনো বিধানকে অস্বীকার করলে সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে যাবে।
তবে যদি কোনো ব্যক্তি জাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তাহলে সে কাফের হবে; ফাসেক হবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৬৮)
জাকাত প্রদানের ফজিলত ও উপকারিতা
জাকাত আদায়ের বহু ফজিলত ও উপকারিতা রয়েছে :
পরিপূর্ণ ঈমানের পরিচায়ক : জাকাত প্রদান ঈমান পরিপূর্ণ করার একটি মাধ্যম। যেমন—রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার ইসলামের (ঈমান) পরিপূর্ণতা হলো তুমি তোমার সম্পদের জাকাত দাও।’ (আত-তারগিব ওআত-তারহিব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩০১, হাদিস : ১২)
আল্লাহর রহমত লাভ : জাকাতদাতার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘এবং আমার রহমত সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে, তাই আমি শিগগিরই তাদের জন্য নিয়ামতসমূহ লিখে দেব, যারা ভয় করে এবং জাকাত দেয়।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৬)
পক্ষান্তরে জাকাত দেওয়া বন্ধ করে দিলে আল্লাহ তাআলা বৃষ্টি দেওয়াও বন্ধ করে দেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে জাতি তার মালের জাকাত দেওয়া বন্ধ করবে, সে জাতির জন্যই আকাশ থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণিকুল না থাকত, তাহলে তাদের জন্য আদৌ বৃষ্টি হতো না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)
সফলতার পথ : জাকাতদাতা কামিয়াব ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে সফল ব্যক্তিদের পরিচয় বর্ণনায় জাকাতকেও গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘অবশ্যই সফলতা অর্জন করেছে মুমিনরা, যারা নিজেদের নামাজে বিনয় ও নম্র এবং যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত আর যারা জাকাত দান করে থাকে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১-৪)
আল্লাহর সাহায্যের উপযুক্ত : যারা জাকাত দেয় আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, শক্তিধর। তারা এমন লোক, যাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রতিটি কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪০-৪১)
জাকাত না দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি
যারা সম্পদশালী এবং জাকাত প্রদানে সক্ষম, কিন্তু তারা তা অমান্য করে এবং জাকাত আদায় করে না, আল্লাহ তাআলা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে মুমিনরা! (ইহুদি) আহবার ও (খ্রিস্টান) রাহিবদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে, যারা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভোগ করে এবং (অন্যদেরকে) আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। যারা সোনা-রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের যন্ত্রণাময় শাস্তির সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে ছেঁক দেওয়া হবে। (আর বলা হবে) এটা তা-ই, যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ করো।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৪-৩৫)
যেসম্পদের জাকাত দেওয়া হয় না, তা অবশ্যই গচ্ছিত মাল যা দ্বারা তার মালিককে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেওয়া হবে। যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সা.) বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সোনা-রুপার মালিক যদি এর জাকাত আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন এই ধন-সম্পদকে আগুনের পাত বানানো হবে এবং জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে। তারপর এগুলো দ্বারা তার পার্শ্ব, ললাট ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। যখনই ঠাণ্ডা হবে পুনরায় তা উত্তপ্ত করা হবে—এমন দিন যে দিনের পরিমাণ দুনিয়ার ৫০ হাজার বছরের সমান হবে। এভাবে বান্দার পরিণতি জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত শাস্তি চলতে থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৮৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, ‘যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় মালা পরিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুই পার্শ্ব কামড় দিয়ে বলতে থাকবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪০৩)
আল্লাহ তাআলা আমাদের পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি এবং আল্লাহর নৈকট্যলাভের আশায় যথাযথভাবে জাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।