সাল ১৯৭৪। ইতালির সুগন্ধিনগরী তুরিনে তখন শরৎকাল। নয় বছরের সার্জিও ক্যানাভেরো প্রতিদিনের মতো ব্যস্ত শহর তুরিনের একটি বইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। এই হাঁটার মাঝেই স্রেফ আগ্রহবশত একটি কমিক বই কিনলেন তিনি। বইটিতে একজায়গায় তিনি দেখতে পেলেন হাসির ছলে একটি কার্টুনের মাথা আর একটি কার্টুনের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সেই থেকেই তার মাথায় একটিই চিন্তা, বাস্তবে কি তা সম্ভব! এরপর থেকে শুরু হয় নানান ভাবনা। ভাবনার এক পর্যায়ে সিদ্বান্ত নিলেন, যদি তিনি বড় হয়ে চিকিৎসক হন তাহলে এই অবাস্তব কাজটি বাস্তবে রুপ দেয়ার চেষ্টা করবেন।
কথায় আছে, মানুষ মন থেকে কিছু চাইলে এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসম্ভবও সম্ভব করা যায়। একদিন সত্যিকার অর্থেই আসলো সেই দিন যখন নয় বছরের ছোট সার্জিও ক্যানাভেরো হয়ে গেলেন চিকিসৎক সার্জিও ক্যানাভেরো। তার বয়স এখন ৫১ বছর। চিকিৎসক হয়ে তিনি ভুলে যাননি তার ছোটবেলার সেই ইচ্ছের কথা। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি তিনি ভাবতে লাগলেন কিভাবে একজন ব্যাক্তির মাথা অন্য একজন ব্যাক্তির মাথায় প্রতিস্থাপন করা যায়। শুধু ভাবনাতেই শেষ নয়, একদিন তিনি দাবি করে বসলেন যে, একজন ব্যাক্তির মাথা আর একজন ব্যাক্তির মাথায় প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। শুধু বলেই নয় করেও দেখালেন তিনি।
সার্জিও ক্যানাভেরোর মতে যদি একটি মানুষের দেহ থেকে কিডনি, হার্ট প্রতিস্থাপন করে অন্য একজনের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায় তাহলে একজনের পুরো মাথা কেন প্রতিস্থাপন করা যাবে না। একটু ১৯৭০ সালের দিকে ফিরে যাওয়া যাক যখন যুক্তরাষ্ট্রের একজন স্বনামধন্য নিউরোসার্জন রবার্ট হোয়াইট সর্বপ্রথম মাথা প্রতিস্থাপন করেছিলেন। তবে তা কোন মানুষের মাথা ছিল না। ওটা ছিল একটি বানরের মাথা। তিনি একটি বানরের মাথা অন্য একটি বানরের মাথায় প্রতিস্থাপন করেছিলেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত মাথা প্রতিস্থাপিত বানরটি বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেনি। কিন্তু যা ওই সময় সম্ভব হয়নি তা একবিংশ শতাব্দীতে এসে সফলতা অর্জন করেছে।
২০১৩ সালের জুন মাসে ক্যানাভেরো একটি নকশা প্রস্তুত করলেন যে কিভাবে একজন মানুষের মাথা অন্য একজন মানুষের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যায় এবং তা আন্তর্জাতিক সার্জিকাল নামক একটি জার্নালে প্রকাশ করেন তিনি। শুধু তাই নয় তার এই চিন্তাধারাটি রিভিউর জন্য ২০১৫ সালে একাডেমি অব নিউরোলোজিকাল অ্যান্ড আর্থোপেডিক সার্জনদের ৩৯তম বার্ষিক সভায় উপস্থাপন করেন। এরপর ওই বার্ষিক সভা থেকে এ ব্যাপারে সবার সম্মতিও পাওয়া যায়।
এরপরই আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষন যখন সবাই প্রস্তুত খুবই সুক্ষ ও জটিল এই অস্ত্রোপচারটি করার জন্য। আর যার মাথাতে প্রতিস্থাপন করা হবে তার নাম হলো ভ্যালেরি স্প্রিনভ। পুরো অস্ত্রোপচারটি করতে চিকিৎসকদের সময় লেগেছিল প্রায় ৩৬ ঘণ্টা। এতে অংশ নিয়েছিল ১৫০ জন ডাক্তার, নার্স, প্রযুক্তিবিদ, মনোবিজ্ঞানী এবং কার্যত প্রকৌশলী। তারা সবাই দুটি দলে বিভক্ত ছিল। একটি দল ছিল ভ্যালেরি স্প্রিনভ এর কাছে। আর একটি দল অপর ব্যাক্তিটির কাছে যার মাথা লাগানো হবে। তবে দুজন রোগীকেই অজ্ঞান করে রাখা হয়েছিল পুরো অস্ত্রোপচার জুড়ে। তবে বাইরে থেকে তাদের টিউবের সাহায্যে শ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তাদের মস্তিস্ক এবং হৃদযন্ত্র সর্বক্ষণ একটি মনিটরের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। এরপর স্প্রিনভ এর মাথা ঠাণ্ডা করা হচ্ছিল ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। কারণ এই তাপমাত্রায় মাথা সমায়িক সময়ের জন্য মৃত বলে ধরে নেয়া হয়। এরপর একজন ভাস্কুলার সার্জন যিনি রক্তনালী সরবরাহের কাজ করেন তিনি খুব সূক্ষভাবে স্প্রিনভের দেহের সঙ্গে মাথার শিরাগুলো যুক্ত করেন। এরপর যে জায়গাগুলো ফাঁকা ছিল সেগুলো সিলিকন টিউব যার নাম সিলাষ্টিক দিয়ে যুক্ত করে দেয়া হয়। এই টিউবগুলো রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে এবং রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ সচল রাখে।
এরপরই আসলো এই অস্ত্রোপচারের সবচেয়ে জটিল কাজ আর তা হলো স্পাইনাল কর্ডের প্রতিস্থাপন। একটি মানুষের স্পাইনাল কর্ড এতটাই সূক্ষ যে, যা প্রতিস্থাপন করা এতটা সহজ নয়। চিকিৎসকদের চাপ তখন বেড়ে গেলো। এদিকে স্প্রিনভের মাথা সংযোজন করতে হবে ডোনারের দেহে তাও এক ঘণ্টার মধ্যে। এরপর খুব সতর্কতার সঙ্গেই স্প্রিনভের মাথা নতুন আর একটি দেহে প্রতিস্থাপন করা হলো এরপর ডোনারের রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিকভাবেই হচ্ছিল এমনকি স্প্রিনভের মাথাও স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পৌছে গেল কিছুসময়ের মধ্যেই। ৩৬ ঘণ্টা পার হওয়ার পরই স্প্রিনভের জ্ঞান ফিরে আসে এবং সে সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছে বলেন চিকিৎসকরা।
অস্ত্রোপচারের পরে সংবাদমাধ্যমকে দেয়া এক বিবৃতিতে সার্জিও ক্যানাভেরো বলেন, ‘আজ আমার স্বপ্ন সত্যিই সফল হলো। যদিও প্রথম দিকে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আমরা আত্মবিশ্বাস আমাকে হারতে দেয়নি।’ অস্ত্রোপাচারে অংশ নেয়া আর একজন চিকিৎসক মাইকেল সার বলেন, ‘সার্জিও মজার মানুষ হলেও তিনি একজন সিরিয়াস ব্যাক্তি।’ এটা শুধু বিজ্ঞান নয় এটিকে কাল্পনিক বিজ্ঞানও বলা যেতে পারে। কাল্পনিক এই অর্থে কারণ মাথা প্রতিস্থাপন শুধু আমাদের কল্পনার বিষয় ছিল যা আজ সত্যিকার অর্থে প্রমাণিত হয়েছে।
তবে মাথা প্রতিস্থাপন শুধু তাদের ক্ষেত্রেই সম্ভব যারা প্যারালাইসের কারণে মাথা নাড়াতে পারে না বা কোন কারণে যাদের মস্তিস্ক অচল হয়ে গেছে। তবে এতকিছুর পরও একটি কথা বলতেই হয় এই অস্ত্রোপচার করতে বিপুল পরিমান অর্থের প্রয়োজন যা সাধারণ কোন ব্যাক্তির পক্ষে মেটানো এক কথায় সম্ভব নয়। তাহলে এই উদ্ভাবন মানুষের হাতের নাগালে আসার আগ পর্যন্ত তা আদৌ মানুষের ঠিক কতটা কাজে আসবে এই প্রশ্ন থেকেই যায়।