বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
জামালপুরে নকল ভিক্সল পাওয়ার তৈরী করে কোটিপতি হওয়ার অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারিকুলাম যুগোপযোগী করার তাগিদ রাষ্ট্রপতির ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস বৈশ্বিক স্বাধীনতা সূচকে ১৬৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১ কাজিপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল  যশোরের শার্শায় সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকের উপর হামলা মান্দায় জোরপূর্বক বাড়িতে ঢুকে হামলা,থানায় অভিযোগ বেলকুচি বাসী ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে তেঁয়াশিয়া নূরানীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায় বৃক্ষ রোপণ করা হয় । ফরিদপুরে বাস-পিকআপ ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১৪ কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর সিএনআই নিউজ আবার চালু

কালিক ভাবনার অনন্য প্রতিভাস

রিপোর্টার নাম
  • আপডেট সময় : 12:31 pm, শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১৮

164314kalerkantho_18_06_07_AK-7

তুহিন ওয়াদুদ : কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তিনজনই বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। অনেক ক্ষেত্রেই এ তিনজন কালজয়ী শিল্পীর সাজুয্য লক্ষণীয়। তাঁদের তিনজনেরই শিল্পীজীবন স্বল্প সময়ের। সুকান্ত ভট্টাচার্য ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ অকালপ্রয়াত। সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র ২১ বছর বয়সে এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ৩৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন। মেধার ভীষণ অপচয় বলা যায় এ মৃত্যুকে। আর কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালে মারা গেলেও তাঁর লেখকজীবন থেমে গেছে মাত্র ৪২ বছর বয়সে।

নজরুল-সুকান্ত-রুদ্র তিনজনই গদ্য ও কবিতা লিখেছেন। তবে তিনজনেরই অধিক পরিচিতি কবি হিসেবে। এ তিনজনের সবচেয়ে বেশি মিল হচ্ছে তিনজনই সময় সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। এই অতিমাত্রায় সচেতনতা তাঁদের সমাজের কাছে দায়বদ্ধ করে তুলেছে। বিষয় নির্বাচনে তাঁরা সমাজের অসংলগ্নতাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। অনেক সময় শিল্প বিচারে যা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহূত হয়, এ তিনজনের জন্য তা-ই ইতিবাচক অর্থে বিবেচিত হয়ে আসছে। সমাজের প্রতি দায় আর শিল্পের প্রতি দায়—এ দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। এ তিনজন লেখকই শিল্পের প্রতি দায়বোধের চেয়ে জীবনের প্রতি দায়বোধকেই বড় করে দেখেছেন। এতে কখনো কখনো শিল্পমূল্য শিল্পমুখী না হয়ে জীবনমুখী হয়েছে। এ তিনজনই শিল্পকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়াররূপে।

সমাজের শোষণ-পীড়ন-বঞ্চনা এ তিন শিল্পীচিত্তে দাগ কেটেছিল। ক্লেদাক্ত সমাজ এই লেখকদের আহত করেছে। ফলে তাঁরা সমাজকে ব্যাধিমুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন কবিতার মোড়কে।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের যত বিশেষণ আছে, তার মধ্যে অন্যতম তিনি বিদ্রোহী কবি। তিনি যখনই কবিতায় তাঁর বিদ্রোহী সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তখনই তাঁর কবিতা পেয়েছে এক স্বতন্ত্র মাত্রা। রবীন্দ্রবলয় থেকে যখন আমাদের লেখকরা বের হতে পারছিলেন না, তখন কাজী নজরুল ইসলাম স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন তাঁর বিদ্রোহী সত্তার দ্বারা। তিনি সমাজের সদর্থক পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে তিনি কবিতা লিখেছেন। ব্রিটিশরা যে আমাদের শোষণ করছে সেই শোষণের বিরুদ্ধে তিনি জ্বলে উঠেছেন। তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেন—আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন,/ আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!/ আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেব পদচিহ্ন! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!’ এ কথাগুলো কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশদের সীমাহীন নির্মম শোষণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলেছেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার লেখনীর কারণে তিনি ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক জেল খেটেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল।

অসাম্প্রদায়িক বোধের কথা বলতে গিয়ে তিনি কখনো মুসলমানদের দ্বারা, কখনো হিন্দুদের দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন। তাঁকে কোনো নিন্দাবাক্যই নিজের দর্শন থেকে ফেরাতে পারেনি। তিনি অনড় ছিলেন সব প্রতিকূলতায়। সময়ের উল্টো স্রোতে ছিলেন নৌকা চালানোর দক্ষ মাঝি।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের প্রধান সুরই ছিল সমাজের সব বৈষম্য দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় লিখেছেন—‘গাহি সাম্যের গান—/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।/ গাহি সাম্যের গান!

কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের প্রচলিত রীতিতে যারা অপাঙেক্তয় জন তাদের প্রতিও ছিলেন সহানুভূতিশীল। স্তরবিশেষে মানুষের গুরুত্বের পরিবর্তে তিনি মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে মর্যাদা দিতে চেয়েছেন। যৌনকর্মীদের উদ্দেশ্য করে তিনি ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় বলেছেন—‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে? হয়েতো তোমায় স্তন্য দিয়েছে সীতা সম সতী মায়ে!’

নজরুল ইসলাম সচেতনভাবেই এসব লিখেছিলেন। তাঁর লেখনী নিয়ে সমকালে অনেক বিদ্রূপ হয়েছে। তাঁর ওপর বিরাগভাজন হয়ে যাঁরা নানা রকম কুত্সা রটিয়েছেন, অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য করে তিনি ‘আমার কৈফিয়ৎ’ নামের একটি কবিতা লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন—‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,/ ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!/ ফতোয়া দিলাম—কাফের কাজী ও,/ যদিও শহীদ হইতে রাজী ও! ‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!/ হিন্দুরা ভাবে, পার্শী শব্দে কবিতা লেখে, ও পা‘ত-নেড়ে!’ কবি নজরুলকে ঘিরে সাধারণ ধর্মান্ধদের মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব থাকলেও তিনি মৌলবাদীদের কথায় নিজেকে পরিবর্তন করেননি; বরং যুক্তিহীন-জ্ঞানহীন-অসার চিন্তার মানুষদের যুক্তির পথে আনার কাজটি করে গেছেন।

সুকান্ত ভট্টাচার্য সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গ ভূখণ্ডেও সমাজতন্ত্র বিকশিত হওয়ার সময়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ তখন ভারতবর্ষে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার সর্বাঙ্গ জুড়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বক্তব্য। ঘুরেফিরে বারবার শোষিতের পক্ষে তাঁর লেখনী উচ্চকিত হয়েছে। বয়সে তরুণ হলেও লেখক গোটা সমাজকে দেখেছেন অখণ্ড শোষিত সমাজ হিসেবে। তিনি তাঁর লেখায় বারবার করে আশাবাদের কথা বলেছেন। ব্রিটিশ শোষণের প্রতি সাহসী উচ্চারণ ছিল তাঁর আমৃত্যু। ‘ছাড়পত্র’, ‘ঘুম নেই’, ‘পূর্বাভাস’ তিনটি কাব্যগ্রন্থই ইতিহাসের ছায়ামাত্র। সময়চিত্রে তাকালে যে অস্থিরতা তা আমাদের ভীষণভাবে ব্যথিত করে, সেই সময়চিত্র কবিতারূপে ফুটে উঠেছে কবির শিল্প প্রতিভাসে।

তাঁর ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের ‘ছাড়পত্র’, ‘প্রার্থী’, ‘একটি মোরগের কাহিনী’, ‘সিঁড়ি, ‘লেনিন’, ‘অনুভব’, ‘সিগারেট’, ‘দেশলাই কাঠি’, ‘বিবৃতি’সহ প্রায় সব কবিতায়ই অভিন্ন সুরের ব্যঞ্জনা। ‘ঘুম নেই’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিক্ষোভ’, বিদ্রোহের গান’, ‘জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুত্বাণী’, ‘আমরা এসেছি’, ‘প্রিয়তমাসু’সহ অনেক কবিতার বিষয় বিন্যস্ত হয়েছে সমকালীন সমাজের অন্তর্গত যন্ত্রণার বাতাবরণে। ‘পূর্বাভাস’ কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রেও বিষয়গত মূল্যায়ন সমপর্যায়ের। সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় নতুনদের জন্য স্থান ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও নিজের দায়িত্বটুকু পালন করে যেতে চেয়েছেন—‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;/জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে/চলে যেতে হবে আমাদের।/চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ তিনি নিষ্পেষিত মানুষের করুণ চিত্র বোঝাতে ‘মোরগ’ রূপকের আশ্রয় নিয়ে লিখেছেন ‘মোরগ’ কবিতাটি। মোরগ যেন ‘আস্তাকুঁড়’ থেকে খাবার সংগ্রহ করছে। সেই খাবারও পর্যাপ্ত নয়। মোরগ একদিন প্রাসাদে প্রবেশ করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিল। লেখক দেখিয়েছেন, মোরগ একদিন প্রাসাদে প্রবেশ করে। তবে কোনো কিছু খেতে নয়, খাবার হয়ে খাবারের টেবিলে। ‘সিঁড়ি’ কবিতায় শ্রমজীবী মানুষকে তিনি সিঁড়ি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তথাকথিত উচ্চ শ্রেণির মানুষরা এই সিঁড়িতে পা ফেলে উঠে যায় ওপরে। যাঁরা এ কাজ করছেন, তাঁদের এ কাজের ধারাবাহিকতা থাকবে না বলেই সুকান্ত ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন। ‘সিগারেট’ এবং ‘দেশলাই কাঠি’ কবিতায় এই জড়বস্তুকেও মানুষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দুটির মধ্যে আগুন জ্বলে। মানুষকে কবি এখানে জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় বলে উল্লেখ করেছেন। যেদিন মানুষ জ্বলে উঠবে, সেদিন সব অন্যায় ভস্মীভূত হবে। লেখক সেই স্বপ্নই লালন করতেন। ‘বোধন’ কবিতায় রীতিমতো কবি ‘মালিক’ এবং ‘মজুদদার’দের প্রতি তীব্র হুমকি প্রদর্শন করেছেন। ভারতবর্ষ থেকে তাদের বিদায় করার কথা বলেছেন। ‘রানার’ কবিতায় কবি পরিশ্রমী মানুষের করুণ ছবি এঁকেছেন। ‘প্রিয়তমাসু’, কবিতার শেষে নিজের অসহায় অবস্থাও তুলে ধরেছেন—‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,/যে সন্ধ্যার রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে/অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,/নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার

সুকান্ত ভট্টাচার্য শ্রমজীবী সহায়হীন মানুষের করুণ আর্তি তুলে ধরতে গিয়ে সরাসরি তা কাব্যে তুলে এনেছেন। কবিতায় পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করলে তা হয়তো শিল্পের জন্য অনুগামী হতো। কিন্তু তীব্র ক্ষোভ-যন্ত্রণা থাকত অনেকটাই অনুপস্থিত। সে কারণে সুকান্ত ভট্টাচার্য সরাসরি যন্ত্রণাদগ্ধ বোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতায়।

স্বল্পায়তনে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর আলোচনা কঠিন। জীবনরেখার দৈর্ঘ্য কম হলেও রচনার বিস্তৃতি কোনো অংশেই কম নয়। তাঁর রচনাগুলো জীবনঘনিষ্ঠ। স্থির লক্ষ্যাভিসারী লেখক তিনি। কালযন্ত্রণার গভীর উপলব্ধি তাঁর রচনাসমগ্র। তাঁর কবিতায় প্রেম আছে। কখনো ব্যক্তিক প্রেম, কখনো স্বদেশপ্রেম পুষ্পিত হয়েছে তাঁর লেখায়। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর কালিক ভাবনাপ্রসূত রচনাই শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর নিজের পঙিক্তমালায় সেই বোধের উন্মীলন লক্ষ করা যায়। ‘শব্দ-শ্রমিক’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘ভাষার কিষান চোখ মেলে চেয়ে দেখি,/চারিপাশে ঘোর অসম জীবন,/সভ্য পোশাকে পাশবিক বন।/সমতার নামে ক্ষমতাকে কোরে রপ্ত,/আমি জানি কারা জীবনে ছড়ায় পুঁজ, পোকা, বিষ তপ্ত—/জানি আমি কারা ধুতুরার ফুলে অন্ধ করেছে অবেলায়, ছুঁড়ে দিয়ে গেছে নষ্ট নগ্ন বেদনায়।’

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কবিতার চরণে তাঁর উপলব্ধির কথা বলেছেন। তিনি নিজেকে শব্দ-শ্রমিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর সারা জীবন ধরে শব্দ-শ্রমিক যেভাবে প্রতিবাদ করতে পারে, প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে, সেই চেষ্টাই করে গেছেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অমর্যাদা হতে দেখে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। যখন অবহেলিত জনপদে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীরাও যখন মাথা নত করে চলে, তখনো এ কবি ছিলেন দৃঢ়চেতা ও সাহসী। তাঁর একেকটি কবিতা যেন একেকটি শেলসম। তিনি শব্দ-শ্রমিক কবিতায় নিজের অবস্থান চিহ্নিত করেছেন। সেখানে তিনি যত অনাচার-অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কথা বলেছেন। তিনি ভুল চেতনায় সংশোধন করেন। মানুষের চেতনায় তিনি প্রেরণা বুনে দেওয়ার কাজ করেন। ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘হাড়েরও ঘরখানি’ কবিতায় তিনি নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এভাবে—‘বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে/রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ/বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে/বুদ্ধিজীবীর রক্ত স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ/বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে/জাতির তরুণ রক্তে পুষেছে নির্বীর্যের সাপ—’

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি লিখেছেন ‘সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি’ কবিতা। শাসকগোষ্ঠী অস্ত্রের মুখে যে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই অস্ত্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠেছিল তাঁর কবিতা।

নজরুল-সুকান্ত-রুদ্র তিন সময়ের মানুষ। ১৮৯৯ সালে জন্মেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ শোষণ-পীড়ন দেখে দেখে বেড়ে উঠেছেন। ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর শিল্পীজীবন ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালে জন্মেছেন। তাঁর লেখার মধ্যে বৈষম্যহীন এবং শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যয় সূচিত হয়েছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জন্মেছেন ১৯৫৬ সালে। পাকিস্তানিদের পৈশাচিক চরিত্র দেখে দেখে তিনি বেড়ে উঠেছেন। এসব দিক বিবেচনা করলে বোঝা যায়, একই সময়ের যন্ত্রণা তাঁরা মলাটবন্দি করেননি। তবে তাঁরা যে যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে শিল্পে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন, সেই যন্ত্রণা অনেকাংশেই সমান। কাজী নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্য ব্রিটিশ পর্বে শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়েছেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ স্বাধীন দেশের অনাচারের বিরুদ্ধে কবিতাকে শাণিত করেছেন। যুগের দাবি মিটিয়ে কবি নজরুল ইসলাম হয়েছেন যুগোত্তীর্ণ। সুকান্ত ভট্টাচার্যও কালের দাবি মেটাতেই সদা ব্যস্ত ছিলেন। এই কবিও সময়ের সীমা অতিক্রম করেছেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহও এ ধারায়ই নিজেকে ঋদ্ধ করে গড়ে তুলেছেন। কালের যন্ত্রণাই তাঁদের শিল্পভুবনের প্রধানতম উপজীব্য ছিল।

বিংশ শতকের প্রায় ৮০ বছরের মধ্যে জমে থাকা বঞ্চনার আলেখ্য উঠে এসেছে এ তিন লেখকের কবিতায়। এই ৮০ বছরে আমাদের শাসক ছিল তিন ধরনের। ঔপনিবেশিক শাসন ছিল ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নব্য ঔপনিবেশিক শাসন যেন জুড়ে বসেছিল। ১৯৭১ সালের পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে।

আলোচ্য তিন লেখকই প্রতিভার সবটুকু দিয়ে একটি সুস্থ চিন্তার রাষ্ট্র গঠনের নেপথ্যে কাজ করে গেছেন। তাঁদের লেখায় স্লোগানধর্মিতা থাকলেও সার্বিক বিচারে সেগুলো সময় ও শিল্পের অনন্য সম্পদে পরিণত হয়েছে।

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই রকম আরো জনপ্রিয় সংবাদ
© All rights reserved © 2017 Cninews24.Com
Design & Development BY Hostitbd.Com